Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

Phone : +8801841-937872      Email : info@anjumantrust.org

Single Blog Title

This is a single blog caption
04
Aug

হজ্ব: আল্লাহর নৈকট্য লাভের আকুতি

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

হজ্ব আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, ইচ্ছা করা বা প্রদক্ষিণ করা। পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনসম‚হে নির্ধারিত পদ্ধতিতে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পবিত্র কাবাঘর ও সংশ্লিষ্ট স্থানসম‚হে বিশেষ কার্যাদি সম্পাদন করাকে হজ্ব বলে। হজ্ব মুসলিম জাতির এক মহাসম্মিলন, শান্তির স্থল ও মুমিনের মিলনমেলা। হজ্ব হলো পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, ঈমানের নবায়ন করা এবং একে অপরের সাথে পরিচিত হওয়ার স্থান। বায়তুল্লাহ অভিমুখে হজ্বের সফর ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত ; যা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের সফর। এ সফর অন্য কোনো উদ্দেশ্যে, লক্ষ্যে, পার্থিব স্বার্থে বা আকর্ষণে নয়, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আকুতিটুকুই একান্ত কাম্য। এতে রয়েছে একই সাথে আত্মিক, শারীরিক ও আর্থিক ইবাদতের অপ‚র্ব সমন্বয়। জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত মক্কা, মিনা, আরাফা এবং মুযদালিফায় আল্লাহ ও তার রাস‚ল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করাও হজ্বের অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেক সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক, বুদ্ধিমান ও সামর্থ্যবান মুসলিম নর-নারীর ওপর জীবনে একবার হজ্ব করা ফরজ। এরপর যতবার হজ্ব করা হবে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে।
ইহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয় স্বজন ছেড়ে হজ্বের সফরে রওয়ানা হওয়া, কাফন পরে আত্মীয় স্বজন ছেড়ে আখিরাতের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো স্মরণ করিয়ে দেয়, ইহরামের কাপড়ের মতো স্বচ্ছ-সাদা হৃদয় নিয়েই আল্লাহর দরবারে যেতে হবে। ইহরাম অবস্থায় সকল বিধি-নিষেধ মেনে চলা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে- মুমিনের জীবন বল্গাহীন নয় বরং আল্লাহর রশিতে বাঁধা। আল্লাহ যেদিকে টান দেন সে সেদিকে যেতে প্রস্তুত।
হজ্ব পরকালের সফরের একটি মহড়া। মৃত্যুর পর বান্দা সাদা কাপড়ে আবৃত হয়। কবর জীবনে ও হাশরের ময়দানে সবাই সমবেত হবে ভেদাভেদহীনভাবে। হজ্বের ইহরামের কাপড় পরিধান, আরাফা, মুযদালেফায় সমবেত হওয়া তারই প্রতিচ্ছবি। পবিত্র মক্কা ও সোনার মদিনায় রাস‚ল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থান দর্শনে ব্যাকুল-বেকারার হয়ে যান আশেকে রাস‚লগণ। প্রেমিক যেমন প্রেমাষ্পদকে পাওয়ার জন্য পাগলের মতো সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। কোথাও সে স্থির থাকে না, থাকতে পারে না। নিজের শরীর, খাদ্য, বিশ্রামের চেতনা থাকে না। তেমন হাজীগণ কাবার চারদিকে ঘুরে, কাবার দরজায়, হাজরে আসওয়াদে, হাতিমে, মিযাবে রহমতের নিচে, মাকামে ইব্রাহিমে, কাবার কোণায় কোণায় কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়। কাকে যেন পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছোটাছুটি করে সাফা, মারওয়ায়, আরাফা, মুযদালেফায়। দিনে-রাতে কোন বিশ্রাম নেই। সফরে আড়ম্বরতা নেই। আলস্য নেই। আবার ছুটে যায় মিনায় শয়তানকে পাথর মারতে, কোরবানি করতে, সেখান থেকে আবার আসে তাওয়াফ করতে। এভাবে সর্বত্র অস্থির, ব্যাকুল সে তার পরম প্রেমাষ্পদ, প্রেমময়, দয়াময়, করুণার আঁধার, মহান আল্লাহর প্রেমে; যে তাকে সৃষ্টি করেছেন, সবকিছু দিয়েছেন না চাইতেই। অলক্ষ্যে জুগিয়ে যাচ্ছেন খাদ্য-পানীয়, বাঁচার উপকরণ, জীবনাবসানে নিজের কাছে ডেকে নেবেন জান্নাতুল ফেরদাউসে, তার আরশের কাছে অনন্ত জীবন থাকার জন্য। এত অসীম ভালোবাসার সেই সত্তাকেই হাজীগণ খুঁজে বেড়ান মৃতের বেশে, পাগলের মতো অস্থির হয়ে হজের সফরে।
হজ্ব সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, মানুষের মধ্যে যার আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে তার উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই ঘরের হজ্ব করা অবশ্য কর্তব্য (আলে ইমরান)।
সকল ইবাদতের মতো হজ্বের প্রাণ হচ্ছে ইখলাস। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হজ্ব করা। লৌকিকতা, সুনাম-সুখ্যাতি, হাজী উপাধি লাভ ইত্যাদি যে কোনো দুনিয়াবী স্বার্থ ও উদ্দেশ্য থেকে এই আমলকে মুক্ত রাখা অতি জরুরি। ইখলাস ছাড়া কোনো আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। রাস‚ল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি লোকসমাজে প্রচারের উদ্দেশ্যে নেক আমল করে, আল্লাহ তা‘আলা তার কর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকদের শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোনো সৎ কাজ করে আল্লাহ তা‘আলাও তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকদের মাঝে প্রকাশ করে দিবেন (বুখারি, মুসলিম)। এ জন্য হজ্বের সৌভাগ্য লাভকারীদের উচিত, আল্লাহতা‘আলার নিকট রিয়ামুক্ত হজ্বের জন্য দোয়া করতে থাকা। এটাই আল্লাহর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর আদর্শ ও শিক্ষা। রাস‚ল -ই পাক এই দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! আমার হজ্ব কে রিয়া ও খ্যাতির আকাক্সক্ষা মুক্ত হজ্ব রূপে কবুল করুন। (বুখারি)
হজ্ব হল বিনয় ও কাতরতা সহযোগে আল্লাহর মহব্বত প্রকাশের ভিতর দিয়ে তার নিকট হতে পাপ ও অপরাধসম‚হ মার্জনা করানো এবং আল্লাহর রহমত ও অনুকম্পা লাভে ধন্য হওয়া।
হাজীদের অন্তরে যখন আল্লাহর রহমত লাভের দৃঢ় প্রত্যয় দানা বেঁধে ওঠে তখনই আল্লাহর অনুকম্পা, ক্ষমা ও দয়া অপরিহার্যরূপে অবতীর্ণ হতে থাকে।
‘মাবরুর (মকবুল) হজ্বের প্রতিদান জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়’। সর্বোত্তম আমল কী এ ব্যাপারে এক ব্যক্তি রাস‚ল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বললেন, ‘অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি ঈমান, তারপর মাবরুর হজ্ব যা সকল আমল থেকে শ্রেষ্ঠ। স‚র্য উদয় ও অস্তের মধ্যে যে পার্থক্য ঠিক তারই মত।’ উত্তম আমল কি এই মর্মে রাস‚ল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, মাবরুর হজ।
হাজ্বীরা সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ করে বলতে থাকে, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাক’। যার অর্থ- ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার, তোমার কোনো শরিক নেই’। মুমিনের হৃদয় থাকে এ আকুলতায়- হাজির হয়েছি ওগো আল্লাহ! হাজির হয়েছি! এসেছি, তোমার ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য এসেছি। আমার সবকিছু তোমার কাছে সমর্পণ করতে এসেছি। এই তালবিয়া পাঠ করে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে পাপমুক্তির আকুল বাসনায় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ হাজি মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হন। এরপর স‚র্যোদয় থেকে স‚র্যাস্ত পর্যন্ত তারা আরাফাতের ময়দানে থাকেন।
ধন-সম্পদ, বর্ণ-গোত্র ও জাতীয়তার দিক থেকে পার্থক্য থাকলেও হজ্ব এসব ভেদাভেদ ভুলিয়ে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়। হজ্ব মুসলমানদের আদর্শিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে। রাজা, প্রজা, মালিক, ভৃত্য সকলকে সেলাইবিহীন একই কাপড় পরিধান করায়। একই উদ্দেশ্যে মহান প্রভুর দরবারে উপস্থিত হয়ে সাম্যের প্রশিক্ষণ দেয়। হজ্ব মানুষকে পারস্পরিক স¤প্রীতি ও শৃঙ্খলা বোধের শিক্ষা দিয়ে সহানুভ‚তিশীল করে গড়ে তোলে। বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ শেখায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, পথ খরচ ও বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছবার মতো বাহন থাকা সত্তে¡ও যে ব্যক্তি হজ্ব করে না সে হয়ত ইহুদী বা নাসারা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে। তিনি আরো বলেন, যে মুসলমান আমার মৃত্যুর পর আমার যিয়ারত করবে সেও তদ্র‚প বরকত পাবে, যেরূপ আমার জীবিত অবস্থায় আমার সাথে মুলাকাত করলে পেত।
হজ্ব যেন এক বিশ্ব সম্মেলন। এ বিশ্ব সম্মেলনে সব শ্রেণী, পেশার, ভাষার, গোত্রের, অঞ্চলের, জাতির মানুষের জাতিতে-জাতিতে, দেশে-দেশে ফেৎনা-ফ্যাসাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ দ‚র করে সবার মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ভালোবাসা সৃষ্টির শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আরাফা ও মোযদালেফার সম্মেলন এরই আহŸান জানায় বিশ্ব মুসলিমকে। এ তাৎপর্য উপলব্ধি করার জন্যই বছরে একবার মহান আল্লাহ এ মহাসম্মেলনের বিধান করেছেন। এর যথার্থতা বাস্তবায়নে মুসলমানদেরই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ তারা জগৎবাসীর কল্যাণের জন্য আবির্ভ‚ত হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ কর। [আলে ইমরান]
হাজরে আসওয়াদ চুম্বন ও স্পর্শ মুমিনের হৃদয়ে সুন্নতের তাজিম বা সম্মান বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করে। কেননা নিছক পাথরকে চুম্বন করার মাহাত্ম কী তা বুঝে আসা আওতার বাইরে। তবুও আমরা চুম্বন করি, যেহেতু রাস‚লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম করেছেন। বুঝে আসুক না আসুক কেবল রাস‚ল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর অনুসরণের জন্যই চুম্বন করা হয় হাজরে আসওয়াদ। এ চুম্বন বিনা শর্তে আল্লাহ ও রাস‚ল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যে নিজেকে আরোপিত করার একটি আলামত। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করার প‚র্বে বলেছেন, ‘আমি জানি নিশ্চয়ই তুমি একটি পাথর। ক্ষতি-উপকার কোনোটারই তোমার ক্ষমতা নেই। রাস‚ল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে চুম্বন করতে না দেখলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না’।
আল্লাহর ঘর মুমিন জীবনের পরম সৌভাগ্যের প্রতীক। ঐ পুণ্যভ‚মিতে পৌঁছে বান্দা তার রবের উদ্দেশ্যে নিজের দাসত্বের এবং মহব্বতের প্রমাণ দেয়। এ ছাড়া সারা দুনিয়ার হাজিদের সাথে ভাব ও মতের আদান-প্রদানে পারস্পরিক কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ অবারিত হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মকবুল হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছু নেই। হজ্বের মাধ্যমে বিগত জীবনের গুনাহ মাপ হয়। আরো বলেছেন- যে ব্যক্তি হজ্ব করে সে যেন নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। আল্লাহপাক বলেন- মানুষের নিকট হজ্বের ঘোষণা করে দাও; তারা তোমার নিকট আসবে পায়ে হেঁটে ও সর্ব প্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে আরোহণ করে। তারা আসবে দ‚র-দ‚রান্তের পথ অতিক্রম করে (হজ্ব)। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবার লালিত স্বপ্ন, বহু আকাক্সিক্ষত পবিত্র হজ্ব- আল্লাহর হুকুম ও রাস‚লের সুন্নত অনুয়ায়ী যথাযথভাবে পালন এবং হজ্বের তাৎপর্য ও শিক্ষা উপলব্ধি করে জীবন পরিচালিত করতে পারি সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: সাংবাদিক, কুমিল্লা।

Leave a Reply

You are donating to : Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

How much would you like to donate?
৳11 ৳111 ৳1,100
Name *
Last Name *
Email *
Phone
Address
Additional Note
Loading...